শিক্ষা ও ক্যারিয়ার

খেলার আনন্দে শেখার একটি দিন

সজীব সরকার

প্রকাশিত: ০১:২৪, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩;  আপডেট: ০২:২৬, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩

খেলার আনন্দে শেখার একটি দিন

বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, রেজিস্ট্রার ইলিয়াস আহমেদ এবং ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান কাজী জাহেদুল হাসান।

খেলা কি কেবলই খেলা? কেবলই হুড়োহুড়ি আর ছুটোছুটি? খানিকটা বিনোদন আর খানিকটা শরীরচর্চা? খেলার উপযোগ আসলে এরচেয়ে আরো অনেক বেশি।

খেলাধুলার মধ্য দিয়ে কেবল প্রতিযোগিতা নয়- শেখা যায় নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলাও। শেখা যায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও টিমওয়ার্ক। সবার সাথে মিশতে শেখা যায়। জয়কে সহজভাবে নিয়ে অহঙ্কারী না হয়ে বিনয়ী হতে শেখা যায়। পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নিয়ে বিজয়ীর সাথে আনন্দ করতে শেখা যায়। জয়-পরাজয় নিয়েই যে জীবন, এ সত্য শেখা যায়। দায়িত্ব নিতে শেখা যায়। খেলাধুলা জীবনকে ইতিবাচকভাবে উপভোগ করতে শেখায় সরাসরি ভূমিকা রাখে। 'স্বাস্থ্যবান' বই পড়েও যা শেখা যায় না, তা শেখা যায় খেলাধুলার মধ্য দিয়ে।

জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো খেলাধুলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পড়াশোনা অবশ্যই দরকার; তবে নিয়মিত খেলাধুলার সুযোগ থাকলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতার পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিকাশের সুযোগ অনেক বেড়ে যায়। নিয়মিত খেলাধুলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহও বাড়িয়ে তোলা যায়। তাদের মধ্যে জীবনের প্রতি ইতিবাচক বোধ বাড়ে।

খেলাধুলার মাধ্যমে নিজের যত্ন নেওয়ার গুরুত্ব বুঝতে শেখা যায়। প্রতিযোগিতার পাশাপাশি পারস্পরিক সহযোগিতার বোধ তৈরি হয়। নিজের ও অন্যের ব্যাপারে ইতিবাচক মূল্যবোধ তৈরি হয়। সবার মধ্যে ইতিবাচক যোগাযোগের সুযোগ ও আওতা বাড়ে। সার্বিকভাবে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক জীবনযাপনের মান বাড়ে।

বিনোদন, শরীরচর্চা আর জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের শিক্ষণ - সবকিছুর জন্যই খেলাধুলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি এই বিষয়গুলোরই প্রয়োগ ঘটিয়েছে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। ২৫ জানুয়ারি (বুধবার) রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকায় প্রস্তাবিত স্থায়ী ক্যাম্পাসের মাঠে দিনব্যাপী নানারকম খেলার মধ্য দিয়ে আনন্দমুখর একটি দিন কাটিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। খেলায় জিতে যেমন তারা আনন্দ করেছে, তেমনি নিজে হেরেও আনন্দ করেছে অন্য বন্ধুর বিজয়ে। কেউ খেলায় অংশ নিয়েছে আবার কেউ সবার জন্য নিজ হাতে খাবার তৈরি করে এনেছে। পিঠা, নাড়ু, ছোলা, মিটবল, রুটি আর বিরিয়ানির মতো খাবারের পাশাপাশি গরম কফি এমনকি হিমশীতল আইসক্রিমও বাদ যায়নি। খেলাধুলা, হার-জিত আর খাওয়া-দাওয়ায় পরিপূর্ণ একটি দিন চমৎকারভাবে কাটিয়েছে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

ছিলো চকলেট দৌঁড় ও হাড়ি ভাঙ্গাসহ নানা খেলার আয়োজন।

উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারি - সবাইকে সাথে নিয়ে খেলাধুলা, গান আর খাওয়া-দাওয়ায় ভরপুর একটি দিন কাটিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ধুলায় গড়াগড়ি আর সুন্দর পোশাকে সেলফি চলেছে পাশাপাশি। এমন একটি আয়োজন আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষার্থীদের বন্ধনকে মজবুত করে। শিক্ষার্থীদের এই কলরবই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিষ্প্রাণ একটি স্থাপনার পরিবর্তে মানবিক একটি মিলনকেন্দ্রে পরিণত করে। শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মধ্যে যে আত্মার বন্ধন, তাকে আরো প্রাণশীল করে তোলে উভয়ের মধ্যে এমন একটি দিন। এমন একটি উপলক্ষেই তো প্রথাগত বাধ্যবাধকতার সীমানায় শিক্ষার্থীরা সীমিত না থেকে নিজেদের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে মেলে ধরতে সাহস করতে পারে এবং সেই আত্মবিশ্বাসটুকু তৈরি করতে পারে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে এই যে মেলবন্ধন, এটিই তো শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত জীবনকে গড়ে দেয়।

খেলাধুলার পাশাপাশি ছিলো শিক্ষার্থীদের নিজের হাতে তৈরি খাবারের আয়োজন।

একজন শিক্ষকের ভূমিকা কেবল শ্রেণিকক্ষে সীমিত থাকতে পারে না; ক্লাসরুমের বাইরেও শিক্ষার্থীর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিক্ষকেরা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন। পড়াশোনা ছাড়াও যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ইতিবাচক, গঠনমূলক ও শিক্ষণীয় যোগাযোগ থাকতে পারে, তা উভয় পক্ষেরই শেখার দরকার রয়েছে।

 দিনশেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই মিলে ফটোসেশন।

জীবনের ক্যানভাস অনেক বড়। ক্লাস আর পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনকে সীমিত করে রাখলে তা শিক্ষার্থীর জন্য যেমন মঙ্গলজনক নয়, তেমনি তা দেশ ও জাতির পক্ষেও মঙ্গলজনক হবে না। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাসহ গান-নাচ-আবৃত্তি-ছবি আঁকা-লেখালেখির মতো সৃজনশীল নানারকম চর্চার সুযোগ করে দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতার পাশাপাশি চিন্তাশীলতা এবং নান্দনিক বোধ বাড়বে। আর এভাবেই আদতে পড়াশোনার সার্বিক মানেরও উন্নতি ঘটে এবং সার্বিক জীবনমানেরও উন্নতি ঘটে।

হেসে-খেলে অর্থাৎ জীবনের সব আনন্দ ধরে রেখেই শিক্ষালাভের সুযোগ কেবল শিশু নয় বরং সব বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানেই খেলাধুলা বা আনন্দ বিসর্জন দিয়ে কেবল ভবিষ্যত কর্মজীবনে প্রবেশের প্রস্তুতিকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়ে নিতে হবে - এ ধারণা একেবারেই ভুল ও ক্ষতিকর। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকরা আনন্দের সাথে শেখার সেই সুযোগ শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করবেন, এটিই তাদের কাছে কাম্য। শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিতভাবে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল ডিগ্রি দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়; বরং দক্ষ জনবল এবং নৈতিক বোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সত্যিকার লক্ষ্য হওয়া চাই। এজন্য এমন আয়োজন সব বিশ্ববিদ্যালয়েই চলমান থাকবে- এমনটিই প্রত্যাশা।

হেসে-খেলে-আনন্দের সাথে শিখুক আমাদের শিক্ষার্থীরা; ইতিবাচক জীবনবোধ জাগ্রত হোক তাদের মধ্যে।

* ছবি : আনিকা আফরোজ বাণী; শিক্ষার্থী, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ।

সজীব সরকার : চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।