লাইফস্টাইল

স্ট্রেস থেকে বেরিয়ে আসুন

সজীব সরকার

প্রকাশিত: ১৪:৫৯, ৭ জুন ২০২৫;  আপডেট: ১৫:০০, ৭ জুন ২০২৫

স্ট্রেস থেকে বেরিয়ে আসুন

মাঝে-মধ্যে একেবারে একা থাকুন, সব কাজ থেকে বিরতি নিন। প্রতীকী ছবি।

উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ নেই - এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। নগরায়ন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, দূষণ থেকে শুরু করে এমন হাজারো কারণ রয়েছে যা প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ তৈরি করছে।

এমন পরিস্থিতি সুস্থ, স্বাভাবিক ও আনন্দময় জীবনযাপনের পথে বড় বাধা। তাই, এসব চাপ কমাতে নানা উপায়ে চেষ্টা করা দরকার। এখানে বিশেষ কিছু ভাবনা-চিন্তা সহজ করে ও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা হলো, যা চর্চার মাধ্যমে কিছুটা হলেও মানসিক স্থিরতা আনা সম্ভব হতে পারে।

  • আপনার চারপাশে যা-কিছু ঘটছে, তার সবকিছুই আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। এটাই বাস্তবতা। মেনে নিন। বাইরের ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও আপনি যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সেটি হলো আপনার প্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ, যা ঘটছে, এসব ঘটনায় আপনি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, চাইলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। জীবনে ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতা হবেই; সব পরিস্থিতিতে নিজের মনকে স্থির রাখতে শিখুন। সব ঘটনাতেই বিচলিত বা ব্যাকুল হয়ে না ওঠার চর্চা করুন।
  • যা ঘটার, তা ঘটবেই। সবসময় আমাদের কাঙ্ক্ষিত ঘটনাই যে ঘটবে, এমন তো কোনো নিয়ম নেই। আমরা চাই না - এমন অনেক ঘটনাও জীবনের নানা পর্যায়ে ঘটতেই পারে এবং ঘটবেই। তাই, এমন একটি মানসিক প্রস্তুতি সবসময়ই রাখা ভালো। তাহলে, নেতিবাচক বা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনায় সহজেই বিচলিত হবেন না।
  • খারাপ কিছু ঘটতে পারে - এমন আশঙ্কায় আগে থেকেই নিজেকে চাপে রাখাটা কোনো কাজের কথা নয়। যা ঘটার আশঙ্কা করছেন, শেষ পর্যন্ত এমনকিছু তো না-ও ঘটতে পারে। বরং, মনকে শান্ত রাখুন এবং খারাপ কিছু যদি ঘটেই, তাহলে সেটিকে কীভাবে মোকাবিলা করবেন বা সমাধান করবেন, সে প্রস্তুতি নিন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দুঃশ্চিন্তা করে করে কি খারাপ কিছু ঘটাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়? নিশ্চয়ই না! তাহলে নিজেকে এমন বাড়তি চাপে রাখার কোনো অর্থ হয় না।
  • আপনার মনের শান্তি, স্বস্তি ও স্থিরতার জন্য নিজের ওপরই নির্ভর করুন; এজন্য কখনোই অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি করা উচিৎ নয়। যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজের মনকে শান্ত ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখাটা খুব জরুরি।
  • জীবনকে সহজ করতে এবং বিনোদনের জন্য অনেক ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে। তবে, এসবের ওপর অতি-নির্ভরশীলতা ঠিক নয়। এসব পণ্য বা সেবা সবসময় ও সব স্থানে আপনার জন্য সহজলভ্য না-ও থাকতে পারে; তখন সেই অভাববোধও আপনার মধ্যে আরেক ধরনের অস্থিরতা বা অশান্তি তৈরি করবে। যেমন : স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে এতোটা আসক্তি ঠিক নয় যে কখনো ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়া কোথাও অবস্থান করতে হলে সেটি নিজের কাছে অসহনীয় ঠেকে। মনের শান্তি বা সুখের উৎস বস্তুগত বা বৈষয়িক হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
  • চীনের দার্শনিক লাওৎ জু বলেছেন, 'নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবতে পারলে পুরো পৃথিবী তোমার কাছে ধরা দেবে।' এর মানে হলো, নিজেকে পর্যাপ্ত, যথেষ্ট ও সম্পূর্ণ মনে করতে শিখতে হবে। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে শেখাটা জরুরি। আত্মবিশ্বাস ও নিজেকে ভালোবাসতে পারার মাধ্যমে অনেক প্রতিকূলতাকেই জয় করা যায়।
  • ভালো বা মন্দ - কোনো সময়ই আসলে চিরস্থায়ী নয়। আনন্দের মুহূর্ত যেমন একসময় কেটে যায়, খারাপ সময়টিও তেমনি একসময় পার হয়েই যায়। কিন্তু, মানুষ যখন খারাপ অবস্থায় থাকে, তখন এটি বিশ্বাস করতে চায় না। ধৈর্য ধরুন, আস্থা রাখুন; কাতর না হয়ে বরং খারাপ পরিস্থিতি থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন।
  • যে ঘটনা বা পরিস্থিতি নিয়ে মনের মধ্যে দুর্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, সেই পরিস্থিতি চাইলেই তো সবসময় বা চট করে বদলে ফেলা যায় না। তাই, নিজের ভাবনাকেই বরং অন্য কোনো বিষয়ের দিকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। চর্চার মাধ্যমে এ সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব।
  • নিজের ভাবনা-চিন্তা বা আবেগকেও সবসময় নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তাই, এমন ক্ষেত্রে বরং ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভুল আবেগ দ্বারা বা ভুল পথে পরিচালিত না হওয়ার বিষয়টি চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করতে হবে।
  • এ অঞ্চলের গৌতম বুদ্ধের কাছ থেকে ইউরোপ শিখেছে : হ্যাপিনেস ইজ আ জার্নি, নট দ্য ডেস্টিনেশন। জীবনের দূরবর্তী কোনো একটি পর্যায়ে গিয়ে আপনি সুখী হবেন, এমন ভাবনা মস্ত বড় ভুল। জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে ভালো থাকার চেষ্টা করুন। দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট আনন্দের ঘটনাগুলোকে উপভোগ করার চেষ্টা করুন। খারাপ সময়গুলোতে ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতি বদলের চেষ্টা করুন। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকুন।
  • কিছু পরিস্থিতিতে ক্ষমা করতে ও ভুলে যেতে হয়। একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়- এমনসব ব্যক্তি ও ঘটনার ক্ষেত্রে নিজের ইগোকে প্রাধান্য দিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগার দরকার নেই। 'ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট' নীতি এসব ক্ষেত্রে আপনার মনের শান্তি বজায় রাখতে সহায়তা করবে।
  • সবকিছুতে 'জয়-পরাজয়' খুঁজতে যাওয়া ঠিক নয়। সবকিছুতে 'যুদ্ধে' নামারও প্রয়োজন নেই। হার-জিতের চেয়ে অনেক সময় বরং মনের শান্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই, নিজের ও পরিবারের শান্তির জন্য অদরকারি তর্ক যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো।
  • জীবনের নানা পর্যায়ে ভালো-মন্দ নানা ঘটনাই ঘটতে পারে এবং ঘটবে। কারো জীবনেই সবসময় সবকিছু ভালো কিংবা সবসময় শুধু খারাপটা ঘটে না। তাই, 'হোপ ফর দ্য বেস্ট, বাট প্রিপেয়ার ফর দ্য ওয়ার্স্ট' - এই নীতি মনে রাখতে পারেন। সবসময় ভালোকিছু যেন ঘটে - এমন প্রস্তুতি নিন। নিজেকে সব কাজের জন্য ভালোমতো প্রস্তুত করুন। কিন্তু, সবসময় কাঙ্ক্ষিত ফল না-ও মিলতে পারে এবং অনেক খারাপ কিছুও ঘটতে পারে - এমন প্রস্তুতিও আগে থেকেই রাখুন। এখন অবশ্য বলা হয়, 'অ্যাকনলেজ দ্য ওয়ার্স্ট, বাট প্রিপেয়ার ফর দ্য বেস্ট'। দুটো কথার মূল কথা আসলে অনেকটা একই।
  • 'আমার সঙ্গেই কেন এমনটা ঘটে' - এটিও আরেকটি ভুল ভাবনা। খারাপ কোনো ঘটনা নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তিমাত্রের সঙ্গেই ঘটে না; কোনো না কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা প্রত্যেকের জীবনেই কম-বেশি ঘটে। এই সহজ সত্যটাকে মেনে নেওয়া দরকার। তাই, এ ক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে, 'অ্যাকনলেজ দ্য ওয়ার্স্ট, বাট প্রিপেয়ার ফর দ্য বেস্ট'।
  • ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে চেষ্টা করুন। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা থাকলে নিজের সঙ্গে, অন্যের সঙ্গে এবং সর্বোপরি জীবনের সঙ্গে ভালো বোঝাপড়ার সুযোগ বাড়ে। এতেও মানসিক অস্থিরতা বা চাপ এড়ানো বা সামলানো সহজতর হতে পারে।
  • ভালো বই পড়া, নাটক বা সিনেমা দেখা কিংবা গান শোনার অভ্যাস থাকলে এসব অভ্যাসও নানা সময়ে মনকে শান্ত করতে বেশ কাজে দেয়। 
  • নিজেকেও যথেষ্ট সময় দিন। নিজের যত্ন নিন। নিজেকে ভালোবাসুন। মাঝে-মধ্যে একেবারে একা থাকুন, সব কাজ থেকে বিরতি নিন। আপনার ভালো থাকার জন্য যেমন এটা দরকার, তেমনি আবার আপনার ভালো থাকাটা আপনার কাছের মানুষদের নিয়ে ভালো থাকার জন্যও খুব দরকার।
  • ব্রিদিং এক্সারসাইজ বা শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম নিয়মিত চর্চা করুন। শরীর সুস্থ রাখার পাশাপাশি এটি আকস্মিক রাগ, ক্রোধ বা এ ধরনের নেতিবাচক আবেগ নিয়ন্ত্রণেও আপনাকে বেশ সহায়তা করবে।
  • এর বাইরেও বিবেচনায় রাখতে পারেন প্রতিদিন কিছুটা সময় যোগব্যায়াম বা শরীরচর্চা, ভোরে বা বিকেলে হাঁটা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বিষয়।

সার্বিকভাবে মনে রাখতে হবে, জীবন ক্ষণস্থায়ী। সময় খুব দ্রুতই গড়িয়ে যায়। ছোট ছোট বিষয়ে ও অকারণে মানসিক চাপ নিয়ে সময় ও জীবন অপচয়ের কোনো মানে হয় না। তাই, সময় থাকতেই নিজের সঙ্গে এ বোঝাপড়াটা সেরে নেওয়া জরুরি।

*এ লেখার উদ্দেশ্য রোগনির্ণয় বা প্রচলিত ধারার চিকিৎসাব্যবস্থা দেওয়া নয়। লেখাটিকে এক ধরনের 'সেল্ফ-হেল্প গাইড' হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। দরকার মনে হলে অবশ্যই চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

সজীব সরকার : সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।