জাপানি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ৭ কৌশল
সজীব সরকার
প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২ মে ২০২৫; আপডেট: ২৩:০৭, ২ মে ২০২৫

পড়াশোনায় ভালো করতে হলে একাগ্রতা থাকা জরুরি। প্রতীকী ছবি।
শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও সাফল্যের উদাহরণ হিসেবে জাপানের নামই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাথায় আসে। সুপ্রাচীন কাল থেকেই দেশটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা কাঠামোয় ইতিবাচক নানারকমের গুণের শিক্ষা ও চর্চার বিষয়টি নিশ্চিত করে আসছে। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো দেশটির শিক্ষাব্যবস্থাও অন্যতম সফল ও অনুকরণীয় মডেল হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনোযোগ, একাগ্রতা ও সৃজনশীলতা গড়ে তুলতে যেসব রীতি বা প্রক্রিয়া দেশটিতে অনুসরণ করা হয়, এর একটি দিক এখানে তুলে ধরা হলো :
১. কাইজেন (kaizen) : কাইজেন শব্দের অর্থ হলো ধারাবাহিকভাবে উন্নতির চেষ্টা করা। 'একবারেই সব করে ফেলবো' - এমন অবাস্তব ও অকার্যকর চিন্তাধারার বদলে একটু একটু করে উন্নতির চেষ্টা নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাওয়ার ভাবনাই হলো কাইজেন। প্রতিদিনই নিজেকে আগের দিনের চেয়ে একটুখানি 'উন্নত' করে তোলার চেষ্টা দীর্ঘমেয়াদে বেশ কার্যকর ও টেকসই হয়। শিক্ষার্থীরা হঠাৎ একদিন বসে সারাদিন-সারারাত পড়ে সব শিখে ফেলবে - এমন চিন্তা না করে প্রতিদিনই আগেরদিনের চেয়ে একটু বেশি সময় যদি পড়াশোনার কাজে ব্যয় করে, তাহলে এতে তারা বাড়তি চাপ বোধ করবে না। পাশাপাশি, শেষদিকে গিয়ে অসহনীয় চাপের মধ্যেও পড়তে হবে না।
২. শোশিন (shoshin) : 'আমি অনেককিছুই জানি না' - এই সরল স্বীকারোক্তিই হলো শোশিন। একজন শিক্ষার্থী যখন উপলব্ধি করবে যে সে সবকিছু জানে না কিন্তু অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তার অনেককিছুই জানার ও শেখার সুযোগ আছে, তখনই আসলে তার মধ্যে অধ্যবসায়ের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে। নতুন নতুন বিষয় জানার ও শেখার জন্য তখন নিজের মনটাকে উদার করাও সহজ হয়। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ এবং নতুন বিষয় জানার সক্ষমতাও বাড়ে।
৩. কানবান (kanban) : কিছুটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে ধার করা এ শব্দটি পড়াশোনার উন্নতির ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যায়। আক্ষরিক অর্থে কানবান বলতে বোঝায় দৃশ্যমান বোর্ড বা সাইনবোর্ড। শিক্ষায় বিষয়টিকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, তা হলো : পুরো শিক্ষণ প্রক্রিয়াটিকে 'করতে হবে', 'করছি' এবং 'করেছি' - এই ৩টি অংশে ভেঙ্গে ফেলা। এমন ৩টি তালিকা মনে মনে বা দৃশ্যমানভাবে তৈরি করে নিয়মিত বিরতিতে মিলিয়ে দেখলে শিক্ষার্থীরা নিজের অগ্রগতি নিজেরাই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে। এতে, শেষদিকে গিয়ে হঠাৎ করে প্রস্তুতিতে অনেক বড় ঘাটতির মুখে পড়তে হবে না।
৪. ইকিগাই (ikigai) : ইকিগাই কথাটিকে সহজে ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে : 'আমি যা করছি, তা কেন করছি' - এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা। শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় বিষয়টিকে এভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় : একজন শিক্ষার্থী যখন জানবে, সে যা পড়ছে-শিখছে, সেটি সে কেন করছে অর্থাৎ এর প্রকৃত বা চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কী, তখন সে কাজটি ভালোভাবে করতে পারবে। একজন শিক্ষার্থী যখন নিজের জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যর সঙ্গে নিজের জ্ঞান, দক্ষতা ও আগ্রহকে মেলাতে পারবে, তখনই সে সবচেয়ে ভালোভাবে শিখবে।
৫. হোরেনজো (horenso) : শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় হোরেনজো মানে হলো কাঠামোবদ্ধ অর্থাৎ রীতিসিদ্ধ যোগাযোগ রক্ষা করা। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে- শিক্ষার্থীরা যা শিখছে, তা নিয়ে নিয়মিতভাবে আলোচনা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা রাখা। শিক্ষার্থীরা যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের শিক্ষক, অভিভাবক বা ওই বিষয়ে অভিজ্ঞ কারো সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা করে, তাহলে তাদের ধারাবাহিক উন্নতি হচ্ছে কি না অথবা তারা যা শিখছে তা সঠিক কি না, এ ব্যাপারে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারবে।
৬. সেইরি (seiri) : এর মানে হলো শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জায়গাটি সুবিন্যস্ত ও যতোটা সম্ভব ফাঁকা রাখা। শিক্ষার্থীর পড়াশোনা করার ঘরে এবং টেবিলে যতোটা সম্ভব কম জিনিসপত্র থাকবে এবং পরিপাটি করে গোছানো থাকবে। এতে মনোযোগে ব্যঘাত ঘটার আশঙ্কাও কমবে। ঘরে ও টেবিলে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা থাকলে শিক্ষার্থীদের পক্ষে মনোযোগ দেওয়া ও তা ধরে রাখা সহজতর হবে।
৭. জানশিন (zanshin) : এটি একাগ্রতা বা নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ, পড়াশোনার সময় শিক্ষার্থীরা একইসঙ্গে একাধিক কাজ (মাল্টিটাস্কিং) করবে না; বরং, তারা যখন যে কাজটি করবে, তখন পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে কেবল ওই কাজটিই করবে। পড়াশোনার সময় তারা যখন যে অংশটুকু পড়ছে, একাগ্র মন নিয়ে তখন কেবল ওই অংশটুকুই পড়বে; এর মধ্যে সে অন্যান্য কাজ করার কথা ভাববে না। পরিপূর্ণ এমন মনোযোগ বা ফোকাস কোনো বিষয় ভালো করে শেখা, উপলব্ধি করতে পারা কিংবা আয়ত্ত করতে পারার পক্ষে সহায়ক।
শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা হচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। ফলে, শতাব্দি এমনকি সহস্রাব্দি প্রাচীন জ্ঞানের পাশাপাশি যুক্ত হচ্ছে নতুন ধারণাও। মনে রাখতে হবে, নির্দিষ্ট একটি পদ্ধতিকে সবার জন্য কার্যকর বলে ধরে নিয়ে বাকি সব পদ্ধতিকে বাতিল করে দেওয়া যায় না। নানা মত-পথ বা পদ্ধতির সমন্বয়েই সবার জন্য কার্যকর শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
সজীব সরকার : সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।