জলবায়ু

চীনের জলবায়ু নীতি কেন সবার জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ

জলবায়ু ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:৩২, ১৩ জুলাই ২০২২;  আপডেট: ০১:১৪, ২৯ অক্টোবর ২০২২

চীনের জলবায়ু নীতি কেন সবার জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে চীনের বর্তমান উদ্যোগ যথেষ্ট নয়।

চীনের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি এবং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন নিজেদের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা না কমালে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানান, চীন ২০৩০ সালের আগেই তাদের কার্বন নিঃসরণ মাত্রার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে, তবে ২০৬০ সালের মধ্যে তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেমে আসবে। অবশ্য এ লক্ষ্য তারা কীভাবে পূরণ করবে, এ বিষয়ে দেশটি স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি।

ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি

বিশ্বের সব দেশই কার্বন নিঃসরণ মাত্রা কমানো নিয়ে জটিলতায় পড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে মূলত চীনেরই। প্রতি ব্যক্তির বিপরীতে চীনের কার্বন নিঃসরণ মাত্রা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অর্ধেক। কিন্তু দেশটির জনসংখ্যা বর্তমানে ১৪০ কোটি। এ ছাড়াও রয়েছে দেশটির বিশাল অর্থনীতি যা ক্রমবর্ধমান। এসব কারণে দেশটির সার্বিক কার্বন নিঃসরণ মাত্রা অন্য সব দেশের তুলনায় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি।

২০০৬ সালে পুরো পৃথিবীর মধ্যে চীন সর্বাধিক পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে; আর বর্তমানে বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের চার ভাগের এক ভাগ এ দেশটি থেকেই হয়ে থাকে। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে অন্যান্য দেশের সাথে চীনও বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন সময় থেকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেশি কিন্তু ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে কম রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে বলে অঙ্গীকার করে। ২০২০ সালে চীন তাদের এ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেছিলো, কিন্তু বর্তমানে দেশটি এ লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে বলে বিজ্ঞানী ও জলবায়ু নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক দল ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার সতর্ক করে।

কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানো

চীনের পক্ষে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে অনেক বিশেষজ্ঞই বিশ্বাস করেন। কিন্তু এজন্যে দেশটির প্রয়োজন বড় ধরনের সংস্কার। দশকের পর দশক ধরে চীনের জ্বালানির বড় উৎস কয়লা। ২০২৬ সাল থেকে দেশটি কয়লার ব্যবহার বন্ধ করে দেবে এবং দেশের বাইরে কয়লানির্ভর কোনো প্রকল্প তৈরি করবে না বলে প্রেসিডেন্ট শি জানান। কিন্তু ওই অনুযায়ী দেশটি কাজ এগিয়ে নিচ্ছে - এমনটি এখনো দৃশ্যমান নয়।

চীনকে ২০৫০ সালের মধ্যে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপরি বন্ধ করতে হবে বলে সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মতামত দিয়েছেন। কয়লার বিকল্প হিসেবে দেশটির পরমাণু ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার শুরু করা উচিত বলেও মনে করেন তারা। কিন্তু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার বদলে চীন বরং নতুন করে এ ধরনের আরো বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে। সম্প্রতি দেশটির ৬০টির বেশি এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো এলাকায় এ কেন্দ্রের সংখ্যা একের অধিক।

নতুন এ কেন্দ্রগুলো সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত চালু থাকবে। তাই চীনকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হলে নতুন এ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কমানোসহ পুরনোগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন প্যারিসভিত্তিক পরিবেশ ও জলবায়ু সংস্থার গবেষক ফিলিপ সিয়েস।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে চীন

চীনের বিদ্যুতের চাহিদার ৯০ শতাংশই পরমাণু ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসা উচিত বলে মনে করেন সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। দেশটির সৌর প্যানেল ও ব্যাটারির ব্যবহার এ লক্ষ্যে পৌঁছার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই আশা করা হচ্ছে। মূলত বায়ু দূষণের মতো সমস্যা এড়াতে চীন প্রথম নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকেছে। তবে এখন এর মধ্য দিয়ে দেশে কর্মসংস্থানের অনেক বড় বাজার সৃষ্টি করাসহ আমদানিযোগ্য তেল ও গ্যাসের ওপর থেকেও নির্ভরতা কমানো সম্ভব বলে মনে করছে চীন। আর এ কারণেই চীনে সাশ্রয়ী দামে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে বলে জানিয়েছে ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট।

বর্তমানে গোটা বিশ্বে সৌর শক্তির ব্যবহার চীনে সবচেয়ে বেশি। দেশটির বিশাল আকারের জনসংখ্যার বিপরীতে এ পরিমাণ নগণ্য হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটি একটি বড় পদক্ষেপ। ২০২০ সালে চীন বিশ্বের অন্য যে-কোনো দেশের তুলনায় ৩ গুণ বেশি বায়ুকল নির্মাণ করেছে। এভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে শুধু এসব খাত থেকেই চাহিদার ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী দেশটি। তবে এর আগেও চীন এ লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন।

বনায়নের পথে

চীনের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার অর্থ এই নয় যে তারা আর কার্বন নিঃসরণ করবে না। বরং এর অর্থ হচ্ছে দেশটির পক্ষে যতদূর সম্ভব নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনা এবং বাকি কার্বন শোষণের ব্যবস্থা করা। আর এর সবই তাদের করতে হবে নানামুখী প্রচেষ্টার সমন্বয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশজুড়ে বনায়নের পরিমাণ বাড়ানো। কারণ যত বেশি গাছ থাকবে, ততই তা নিঃসৃত কার্বন বাতাস থেকে শুষে নিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বনায়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে চীন এরই মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বনায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
 
পরবর্তী পদক্ষেপ কী

চীন সফল হোক, এটাই গোটা বিশ্বের প্রত্যাশা। কেননা চীন সুবিশাল একটি দেশ যে আবার কার্বন নিঃসরণের দিক থেকেও অনেক এগিয়ে। তাই চীনের কার্বন নিঃসরণের হার বৈশ্বিক জলবায়ু পরিস্থিতির জন্যেই ভাবনার বিষয়।

এ বিষয়ে ল্যাঙ্কাস্টার এনভায়রনমেন্ট সেন্টারের অধ্যাপক ডেভিড টাইফিল্ড বলেন, 'চীন কার্বন নিঃসরণের মাত্রা না কমালে আমাদের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।'

এ ক্ষেত্রে চীনের সুবিধা হলো, দেশটির দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সক্ষমতা এবং বড় আকারের বিনিয়োগের সুযোগ থাকা। অতএব, চীনা কর্তৃপক্ষের কাঁধে এখন বিশাল দায়িত্ব। তাই ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে, এর চেয়ে বরং এ দায়িত্ব বাস্তবায়ন করাটাই অনেক বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তথ্যসূত্র : বিবিসি।