ফিচার ও মতামত

‘এক চীন নীতি’ প্রশ্নে চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

নুসরাত জাহান

প্রকাশিত: ০০:০২, ২৩ জানুয়ারি ২০২৪;  আপডেট: ২৩:৪৯, ২৮ জানুয়ারি ২০২৪

‘এক চীন নীতি’ প্রশ্নে চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

তাইওয়ান আলাদা কোনো রাষ্ট্র নয় বলে সবসময়ই দাবি করে আসছে চীন।

সম্প্রতি তাইওয়ানে অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি)। এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশ অভিনন্দন জানিয়েছে দলটির নতুন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাইকে (লাই চিং-তে নামেও তিনি পরিচিত)।

এদিকে কয়েকদিন আগে প্রায় তিন বছর পর আবারও অনুষ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সামরিক পর্যায়ের বৈঠক। এ বৈঠকে চীন স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে যে তাইওয়ান প্রশ্নে তারা কোনো আপস করবে না। এমনকি এই তাইওয়ান ইস্যুতেই ২০২১ সালের পর থেকে এ ধরনের বৈঠকে অংশ নেওয়া থেকে বিরত ছিলো চীন।

তাইওয়ান আলাদা কোনো রাষ্ট্র নয় বলে সবসময়ই দাবি করে আসছে চীন। এমনকি তাদের মতে, এ দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে মূল চীনা ভ‍ূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। চীন স্বায়ত্ত্বশাসিত এ রাষ্ট্রটি কখনো সরাসরি শাসন না করলেও এশিয়ার ক্ষমতাধর এ দেশটি বরাবরই একে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে। এমনকি তাইওয়ানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের আগে সে দেশের জনগণকে ভোটে অংশ না নিতেও সতর্ক করেছিলো চীন। এর ব্যতিক্রম হলে দেশটিতে সংঘাত তৈরি হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়।

কিন্তু চীনের সব বাধা উপেক্ষা করেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে ভোট দিলো তাইওয়ানবাসী। আর এতে তারা এমন এক দলকে জয়ী করেছে, যারা বরাবরই স্বাধীন তাইওয়ানের পক্ষে। নির্বাচনে জয় পেয়ে প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই বলেছেন, ‘আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ধারা অনুযায়ীই দায়িত্ব পালন করবো। একইসঙ্গে আমরা তাইওয়ানকে চীনের অব্যাহত চাপ ও হুমকি থেকে রক্ষায়ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’

একসময় এ সমস্যার সমাধান হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। বিজয় পরবর্তী দেওয়া ভাষণেও তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। লাই বলেছেন, ‘চীন একসময় নতুন এ পরিস্থিতি মেনে নেবে এবং এ অবস্থায় একমাত্র শান্তিপূর্ণ সম্পর্কই দুই পক্ষের জন্য সুফল বয়ে আনবে, এটা তারা অনুধাবন করবে বলে আমরা আশা করি।’

কিন্তু, আপাতত চীনের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বলেই বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। এমনকি তাইওয়ানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানানোয় চীনের কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। কারণ হিসেবে চীন বলছে, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামীদের ‘ভুল বার্তা’ দিচ্ছে। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে শুধু ‘অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক’ বজায় রাখবে বলে যে অঙ্গীকার করেছিলো, এর মধ্য দিয়ে তারা তা ভঙ্গ করেছে।

তবে তাইওয়ানের নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানালেও একই সময়ে একে ‘অনানুষ্ঠিক সম্পর্ক’ বলেই দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসঙ্গে তারা চীনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী বলেও জানিয়েছে। তাছাড়া ‘এক চীন নীতি’কে সমর্থনের কথাও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র । আর তাদের এ বক্তব্য তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে একীভূত করার পথ সুগম করবে বলে আশা করছে চীন।

তবে অনানুষ্ঠানিক বলা হলেও উইলিয়াম লাই দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পরই তার সঙ্গে আলোচনার জন্য তাইওয়ানে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানের নির্বাচিত দলকে অভিনন্দন জানিয়েছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্স।

অন্যদিকে, তাইওয়ানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানানোয় চীনের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে ফিলিপাইনকেও। এমনকি, এ ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করতে দেশটিতে নিযুক্ত ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূতের ওপর সমনও জারি করেছে চীনের পররাষ্ট্র দফতর। তবে ফিলিপাইন দাবি করেছে, তারা ‘এক চীন নীতি’র পক্ষে এবং এ অভিনন্দন জানানোর ঘটনা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ অবস্থায় চীনের জন্য কিছুটা স্বস্তি হয়ে এসেছে মাইক্রোনেশিয়া অঞ্চলের দেশ নাউরু। কারণ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার ছোট এ দ্বীপ দেশটি তাইওয়ানের সঙ্গে কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। একইসঙ্গে তাইওয়ান কোনো সার্বভৌম দেশ নয়, বরং চীনের একটি অংশ বলেও দেশটি মন্তব্য করেছে। তবে তাইওয়ান দাবি করেছে, চীনের চাপের মুখে পড়ে এ কথা বলছে নাউরু।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নাউরুর এ সিদ্ধান্তের পর এখন শুধু ভ্যাটিকান, গুয়াতেমালা ও প্যারাগুয়েসহ মাত্র ১২টি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রইলো তাইওয়ানের। এ অবস্থায় ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন তাইওয়ানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এ ক্ষেত্রে সমীকরণকে জটিল করে তুলেছে।

‘এক চীন নীতি’ কী

‘এক চীন নীতি’ হচ্ছে এমন এক নীতি যেখানে ‘চীন’ নামে একটিই সার্বভৌম রাষ্ট্র থাকবে। এর আনুষ্ঠানিক নাম হবে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি) এবং তাইওয়ান হবে এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু একইসঙ্গে দ্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি) এবং দ্য রিপাবলিক অব চায়না (আরওসি) বা চীন ও তাইওয়ান নামে অলাদা দুটি রাষ্ট্র থাকবে না।

‘এক চীন নীতি’ ধারণার সূত্রপাত যেভাবে

চীনা গৃহযুদ্ধের সময় (প্রথম পর্যায় : ১৯২৭-১৯৩৭ ও দ্বিতীয় পর্যায় : ১৯৩৭-১৯৪৫) চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) দেশটির জাতীয়তাবাদী দল বা কুওমিনটাঙ্গ (কেএমটি) - দের পরাজিত করে। এ সময় দলটি পরাজিত হয়ে চীনের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ তাইওয়ানে গিয়ে তাদের ঘাঁটি গাড়ে। এ সময় সিসিপি চীনের মূল ভূখণ্ডে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি) গড়ে তোলে। একইসময় তাইওয়ান ও আশেপাশের আরও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ছোট দ্বীপ নিয়ে কেএমটি গড়ে তোলে দ্য রিপাবলিক অব চায়না (আরওসি)। তবে একইসময় উভয় ভূখণ্ডের সরকার ও দলই পুরো তাইওয়ানসহ মূল চীনা ভূখণ্ডেকে নিজেদের বলে দাবি করতে থাকে। তখন বৈধতার প্রশ্নে এ দুই দলের সঙ্গে গোটা বিশ্বও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। অবশ্য ৭০’র দশকে আরওসির পরিবর্তে পিআরসির পক্ষেই সমর্থন জোরালো হতে থাকে যার মধ্যে ১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দ্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’র (পিআরসি) পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। ১৯৭২ সালে পিআরসি’র সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে ‘এক চীন নীতি’ বাক্যটি প্রথম ব্যবহৃত হয়।

১৯৯০ সালে আরওসি’র প্রেসিডেন্ট লি তেঙ্গ-হুয়ি রিপাবলিক অব চায়নার সংবিধানের বর্ধিত অনুচ্ছেদ পাস করেন যেখানে তাইওয়ানকে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন করা হয়। একইসঙ্গে শুধু তাইওয়ানের সীমানার মধ্যে এর নাগরিকদের সীমিত আকারে কিছু নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারও দেওয়া হয়। তবে এর মধ্যে আলাদা ভূখণ্ড বা জাতীয়তাবাদ দাবি করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তবে আরওসির মধ্যেই ‘এক চীন নীতি’ নিয়ে বিভক্তি দেখা দেয়; অর্থাৎ কেএমটিসহ অন্যান্য কিছু রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত ‘প্যান-ব্লু কোয়ালিশন পার্টি’র সদস্যরা নিজেদের মতো করে এক চীন নীতির পক্ষে অবস্থান নিলেও ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টিসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত ‘প্যান-গ্রিন কোয়ালিশন পার্টি’র সদস্যরা সম্পূর্ণভাবেই একে বাতিল করে দেয়। তবে পিআরসি বরাবরই ছিলো ‘এক চীন নীতি’র ধারণায় বিশ্বাসী।

প্রেসিডেন্ট লাই এবং তার সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট সিআও বি-কিম - দুজনকেই বেইজিং অপছন্দ ও অবিশ্বাস করে।

তাইওয়ানের উল্লেখ্যযোগ্য রাজনৈতিক দলসমূহ

প্যান-ব্লু কোয়ালিশন পার্টি : তাইওয়ানের উদারপন্থী রাজনৈতিক জোট বা দল যেখানে কুওমিনটাঙ্গ (কেএমটি) ছাড়াও রয়েছে পিপল ফার্স্ট পার্টি (পিএফপি), নিউ পার্টি (সিএনপি), নন-পার্টিসান সলিডারিটি ইউনিয়ন (এনপিএসইউ) এবং ইয়াং চায়না পার্টি (ওয়াইসিপি)। কুওমিনটাঙ্গদের দলীয় রং থেকে এ জোটের নামকরণ করা হয়েছে। এ দলটি ‘বৈধ চীনা সরকার’ বলতে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি) নয় বরং দ্য রিপাবলিক অব চায়নাকে (আরওসি) বুঝিয়ে থাকে। একইসঙ্গে দেশটি তাইওয়ানের বাসিন্দাদের জন্য আলাদা বা বিশেষ পরিচয় নয় বরং চীন ও তাইওয়ানের দ্বৈত নাগরিকত্ব দাবি করে এবং এ বিষয়ে পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার সঙ্গে সমঝোতার পক্ষে। কিন্তু এটি আবার প্যান-গ্রিন কোয়ালিশনের মতাদর্শের বিপরীত।

প্যান-গ্রিন কোয়ালিশন পার্টি : এটি তাইওয়ানের (রিপাবলিক অব চায়না) জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক জোট বা দল। এ জোটে রয়েছে : ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি), তাইওয়ান স্টেটবিল্ডিং পার্টি (টিএসপি), তাইওয়ান সলিডারিটি ইউনিয়ন (টিএসইউ), সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসডিপি), গ্রিন পার্টি তাইওয়ান এবং তাইওয়ান কনস্টিটিউশন অ্যাসোসিয়েশন (টিসিএ)। দলটির রং মূলত ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি থেকে নেওয়া যারা মূলত ‘পরমাণু বোমা বিরোধী আন্দোলন’র সঙ্গে যুক্ত। এ ধারণা থেকেই দলটির মূল রং ‘সবুজ’। এ জোট সম্পূর্ণভাবে তাইওয়ানের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং ‘এক চীন নীতি’র বিরোধী যা প্যান-ব্লু কোয়ালিশন পার্টির সম্পূর্ণ বিপরীত।

ডিপিপি কেন চীনের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ

প্যান-ব্লু কোয়ালিশন পার্টির অন্তর্ভুক্ত দলগুলো ‘এক চীন নীতি’ নয় বরং তাইওয়ানের স্বায়ত্ত্বশাসনে বিশ্বাসী। তবে কিছু ক্ষেত্রে তারা চীনের সঙ্গে আপসের পক্ষে। অর্থাৎ এ জোটভুক্ত দলগুলো তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ বা তাইওয়ানের বাসিন্দাদের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে পরিচয়ের পক্ষে নয়। বরং, তাদের ধারণা মতে, তাইওয়ানবাসী হবে একইসঙ্গে চীনেরও নাগরিক এবং এ ক্ষেত্রে তাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকবে।

এমনকি প্যান-ব্লু কোয়ালিশনভুক্ত দল কুওমিনটাঙ্গ (কেএমটি)-এর নির্বাচনী প্রচারণার সময় অনেক ভোটারের মধ্যে এ আশঙ্কাও দেখা গিয়েছিলো যে এ দলটির জয়ের মধ্য দিয়ে চীন হয়তো এ দ্বীপটিকে আক্রমণ করে বসবে। কারণ, এ দলটি ক্ষমতায় থাকার সময় থেকেই চীনের সঙ্গে আলোচনায় উৎসাহী ছিলো। এমনকি ২০১৫ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কেএমটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেষবারের মতো সাক্ষাৎ করেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট। আর সেটি ছিলো ১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধের পর দেশদুটির প্রধানদের মধ্যে প্রথম কোনো সাক্ষাতের ঘটনা। কিন্তু এর পর গত ৮ বছরে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো সংলাপ বা বৈঠক হয়নি।

তবে তাদের শাসনামলে কেএমটি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমানোসহ সেনাবাহিনীর কার্যক্রমও সীমিত করে। ফলে তারা ক্ষমতায় এলে তাইওয়ান নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে বলেই ভোটারদের মধ্যে আশঙ্কা ছিলো। অতএব, বলা চলে, এ ক্ষেত্রে ভোটাররাও খুব সচেতনভাবে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেইজিং তাদের জন্য বড় একটি হুমকি- এটি যেমন তারা জানে, তেমনি তারা আবার দেশটির সঙ্গে আলোচনারও পক্ষে। কিন্তু তরুণ ভোটার, যারা নিজেদের চীনা নয় বরং তাইওয়ানি হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, তাদের কাছে কেএমটি নিজেদের শক্ত কোনো অবস্থান তুলে ধরতে পারেনি বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

অন্যদিকে, প্যান-গ্রিন কোয়ালিশন পার্টির অন্তর্ভুক্ত দলগুলো কখনোই যেমন দ্বৈত নাগরিকত্বের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলো না, তেমনি ‘এক চীন নীতি’র ধারণারও তারা সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং, তাদের মতে তাইওয়ান সম্পূর্ণ স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র এবং এটি কখনোই চীনের সঙ্গে একীভূত হবে না। আর, এর নাগরিকরাও স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক।

উইলিয়াম লাইয়ের নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও তিনি বারবার এ কথাই বলেছেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ তাইওয়ান স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ - এবং এর নাম হচ্ছে রিপাবলিক অব চায়না-তাইওয়ান।’

লাই মূলত ডিপিপির ‘নতুন ধারার’ সদস্যদের একজন যারা তাইওয়ানের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করে। কিন্তু লাই এবং তার সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট সিআও বি-কিম - দুজনকেই বেইজিং অপছন্দ ও অবিশ্বাস করে। এমনকি অপছন্দ ও অবিশ্বাসের মাত্রা এতোই বেশি যে তাদের চীন ও হংকং ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটি।

অন্যদিকে, আমেরিকান মা ও তাইওয়ানি বাবার মেয়ে সিআও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে তাইওয়ানের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। আর, এসব কারণে তাইওয়ানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপের কোনো আগ্রহই প্রকাশ করেনি চীন। এমনকি ২০১৬ সাল থেকেই দেশটির সঙ্গে সব ধরনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে চীন। আর ডিপিপির জয়ের মধ্য দিয়ে এ সংকট আরও দীর্ঘায়িত হওয়ারই আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

তাইওয়ান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

বহু বছর ধরে উষ্ণ সম্পর্ক বিরাজ করার পর ১৯৭৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের শাসনামলে চীনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দিলেও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পর এর রাজধানী তাইপেতে অবস্থিত তাদের দূতাবাসটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু একই বছর তারা ‘তাইওয়ান রিলেশন অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করে, যার মধ্য দিয়ে তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের বিষয়টি নিশ্চয়তা পায়। কারণ, এ আইনে বলা হয়েছে তাইওয়ানের আত্মরক্ষা প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই এ দেশটির পাশে থাকবে। আর আইনের এ ধারার দোহাই দিয়েই অব্যাহতভাবে দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসময়ে চীন-তাইওয়ান প্রশ্নে এ দু’পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ মিটিয়ে এ সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথাও বলে আসছে তারা। এ লক্ষ্যে এমনকি প্রায়ই দেশদুটিকে আলোচনায় বসার তাগিদও দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।

বর্তমানে তাইওয়ানে ‘আমেরিকান ইনস্টিটিউট’ নামের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাইপেতে তাদের ‘অনানুষ্ঠানিক’ উপস্থিতি বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এর মধ্য দিয়ে মূলত তাইওয়ানের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশটি।

সবচেয়ে বড় বৈদেশিক সাহায্যই হোক বা সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক অংশীদার - সব দিক বিবেচনাতেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যাপক লাভজনক।

শেষ পর্যন্ত কার পাল্লা ভারী

সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটা বলা যায় যে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে তাইওয়ানকে সাহায্য করে আসলেও কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে লাভবানটা আসলে চীনই হচ্ছে। কারণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাইওয়ান এখনও পর্যন্ত বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি পায়নি। এমনকি জাতিসংঘও এখনও একে পৃথক একটি দেশ হিসেবে মেনে নেয়নি। ফলে এ রাষ্ট্রটির অলিম্পিকের মতো খেলার আসর ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো গুটিকয়েক আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া আর তেমন কোনো কার্যক্রম নেই।

অন্যদিকে, বর্তমানে সারা বিশ্বেরই অর্থনীতির একটি বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে চীন। এশিয়ার দেশগুলো ছাড়াও পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বড় বড় অর্থনীতির দেশই চীনা বাণিজ্যের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এছাড়া এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতি ও ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারকারী দেশ হিসেবেও নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সক্ষম হয়েছে চীন।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বৈদেশিক সাহায্যই হোক বা সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক অংশীদার - সব দিক বিবেচনাতেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখাটা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যাপক লাভজনক। তাছাড়া বাণিজ্য ছাড়াও ভূরাজনৈতিক বিবেচনাতেও এশিয়া মহাদেশে শক্ত অবস্থান রয়েছে চীনের, যার ফলে দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যুক্তরাষ্ট্রের নিজ স্বার্থেই প্রয়োজন। কারণ, এশিয়া অঞ্চলে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই চীনের বিরাগভাজন হলে চলবে না। তাই, তাইওয়ানের সঙ্গে আপাতঃনীরব একটি সম্পর্ক বজায় রাখলেও নিজ স্বার্থেই ‘এক চীন নীতি’র মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে দশকের পর দশক ধরে খুব ভারসাম্যপূর্ণ একটি অবস্থান রক্ষা করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এ অবস্থায় ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের ক্ষেত্রে তাইওয়ান সরকারের ভূমিকা এখানে নিঃসন্দেহে একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। একইসঙ্গে ‘এক চীন নীতি’ প্রশ্নে এ সরকারের অবস্থানের ওপরও দৃষ্টি থাকবে পুরো বিশ্বের।