ফিচার ও মতামত

অনলাইন পত্রিকার বড় চ্যালেঞ্জ বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন

সজীব সরকার

প্রকাশিত: ১৪:১৮, ১৪ জুলাই ২০২২;  আপডেট: ০১:১৪, ২৯ অক্টোবর ২০২২

অনলাইন পত্রিকার বড় চ্যালেঞ্জ বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন

সংবাদমাধ্যমের মূল শক্তি হলো সত্যের মাধ্যমের অর্জিত পাঠকের আস্থা। প্রতীকী ছবি।

বিগত প্রায় দুই দশকে বাংলাদেশে অনলাইন পত্রিকার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে দেশে অনলাইনভিত্তিক অনেকগুলো পত্রিকা গড়ে উঠেছে। সংখ্যায় বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠলেও এসব পত্রিকা এখনো পাঠকের মধ্যে অতোটা আস্থা তৈরি করতে পারেনি, যা মূলধারার বা পুরনো মাধ্যম হিসেবে পত্রিকা-রেডিও-টেলিভিশন পেরেছে। এই আস্থাহীনতা কেবল বয়সে নবীন হওয়ার জন্যেই নয়; নানা রকমের হীন স্বার্থে এসব পত্রিকার যে অপব্যবহার হচ্ছে, সেটিও এজন্যে অনেকাংশেই দায়ী।

বহু গবেষণার পর বিশ্বের নানা প্রান্তের গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, অদূর ভবিষ্যতে অনলাইন প্লাটফর্মই হতে যাচ্ছে গণমাধ্যমের চূড়ান্ত পরিণতি বা শেষ গন্তব্য। কিন্তু অনলাইন পত্রিকাগুলো, অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এজন্যে প্রস্তুত হতে পেরেছে কি?

ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইস সহজলভ্য হওয়ার কারণে অনলাইন পত্রিকাগুলো খুব কম সময়ের মধ্যে এতোটা বিকাশ বা বিস্তার লাভ করেছে। এসব পত্রিকায় অন্য গণমাধ্যমগুলোর মতো এতো বড় অঙ্কের আর্থিক ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগ সবসময় জরুরি নয়। নিতান্তই নগণ্য আয়োজনে একটি অনলাইন পত্রিকা চালু করা সম্ভব। এই সুযোগে এমন অনেকেই নিতান্ত শখের বশে কিংবা বিশেষ কোনো স্বার্থে একটি অনলাইন পত্রিকার প্রকাশক বা সম্পাদক বনে যাচ্ছেন, যার পত্রিকা বা সাংবাদিকতার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। আর এই প্রবণতাই অনলাইন পত্রিকার প্রতিষ্ঠা লাভের পথে বড় একটি বাধা। এ কারণে, সংখ্যায় বাড়লেও এসব পত্রিকার গুণগত মান ঠিক কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়েনি।

সাংবাদিকতায় মৌলিক কিছু নৈতিকতা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রথম শর্তই হচ্ছে, সাংবাদিকতায় মিথ্যার কোনো স্থান নেই। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোনো তথ্য 'খবর' হিসেবে প্রকাশ করা যাবে না। যা সত্য, শুধু সেটুকুই বলতে হবে এবং তা বলতে হবে একেবারেই নির্মোহভাবে ও পুরোপুরি পক্ষপাতহীন হয়ে অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে। সত্যের সঙ্গে রং চড়ানোর কোনো সুযোগ এখানে নেই। এ ছাড়া, বাস্তব তথ্যের মধ্যে কোনোরকম বিকৃতি ঘটানো যাবে না। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে অনুমানের ভিত্তিতে কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। ভুল তথ্য পরিবেশন করা যাবে না। পাঠকের বা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, গুজব বা আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না। সাংবাদিকতার নামে কারো ব্যক্তিগত জীবনে (প্রাইভেসি) অনুচিত অনুপ্রবেশ এখানে অনুমোদিত নয়। জেন্ডার অসংবেদনশীল শব্দ-বাক্য-ভাষায় কোনো খবর বা অসংবেদনশীল কোনো ছবি প্রকাশ করা যাবে না। নির্ভরযোগ্য সূত্রের উল্লেখ ছাড়া কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। সমাজের জন্যে ক্ষতির কারণ হয়- এমন তথ্য বা খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্ক হতে হবে এমনকি প্রয়োজনে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

নৈতিক এমন আরো অনেক বিধি-নিষেধ সাংবাদিকরা মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু বাংলাদেশের অনলাইন পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালে এসব ইস্যুতে তাদের যে অবস্থান আমরা দেখি, তা কোনো বিচারেই ইতিবাচক নয়।

পাঠক বা প্রতিদিন ভিজিটরের সংখ্যার সঙ্গে অনলাইন পত্রিকাগুলোর নানা রকমের স্বার্থ জড়িত। এই সংখ্যার ওপর এসব পত্রিকার তথাকথিত জনপ্রিয়তা এমনকি আর্থিক লাভ-লোকসানের বিষয়টিও নির্ভর করে। তাই পাঠক বা 'ক্লিক' বাড়াতে অর্থাৎ সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে কিংবা আর্থিকভাবে লাভবান হতে এসব পত্রিকা খুব সাধারণ ঘটনাকেও বেশ রং চড়িয়ে উপস্থাপন করছে (ক্লিক জার্নালিজম)। পাঠক পেতে ভুয়া তথ্য বা গুজব ছড়াতেও কিছু পত্রিকা দ্বিধা করছে না। নিজেদের মনগড়া খবর তৈরি করছে অনেকে। ধর্ষণের মতো চরম মাত্রার যৌন সহিংসতার ঘটনাও তারা তুলে ধরছে 'ইরোটিক সাহিত্যের' মতো। নর-নারীর স্বাভাবিক সম্পর্ক কিংবা যৌন বা প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যও অনেকে তুলে ধরছে প্রচলিত ভাষায় 'রগরগে' উপায়ে, 'সুড়সুড়ি' দিয়ে। বাস্তব তথ্যের চেয়ে কল্পনা বা অতিকথন এসব পত্রিকার মূল পুঁজি হয়ে উঠেছে। সত্য নয় বরং 'হলুদ সাংবাদিকতা' এসব পত্রিকার মূল পুঁজি।

সাংবাদিকতার মূল শক্তিই হলো সত্যের শক্তি, বিশ্বাসযোগ্যতার শক্তি। কিন্তু বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ অনলাইন পত্রিকার যে চরিত্র আমরা দেখছি, তাতে পাঠকের কাছে দীর্ঘমেয়াদে আস্থাভাজন হয়ে ওঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ক্লিক জার্নালিজমের মাধ্যমে অর্থাৎ কোনো খবরে রং লাগিয়ে 'সুড়সুড়ি দিয়ে' বিশেষ কিছু পাঠককে সাময়িকভাবে আকৃষ্ট করার মধ্য দিয়ে একটি পত্রিকা শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারে না। সত্যিকার পাঠক শেষ পর্যন্ত আসলে নির্ভরযোগ্য তথ্য চায়।

বাংলাদেশে দুই রকমের অনলাইন পত্রিকা রয়েছে : একটি হলো কেবলই অনলাইননির্ভর পত্রিকা আর অন্যটি হলো অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমের (যেমন : পত্রিকা বা টিভির) অনলাইন ভার্সন। পাঠক বাড়াতে দেশের প্রথম সারির বা প্রতিষ্ঠিত অনেক সংবাদমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনেও অরুচিকর ভাষা ও ছবি ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের অনলাইন ভার্সনগুলোর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অরুচিকর প্রতিযোগিতায় নামার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত অনলাইন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রটির ভিত আরো নড়বড়ে হচ্ছে। এভাবে শেষ পর্যন্ত অনলাইন পত্রিকার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে আরো দুর্বল করা হচ্ছে।

বিশ্বাসযোগ্যতাই হলো একজন সাংবাদিক ও একটি সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে বড় পুঁজি। পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা না পেলে সাংবাদিক হিসেবে ব্যক্তি এবং সংবাদমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠান - দুটোই আসলে ব্যর্থ। তাই সাময়িক ও সস্তা জনপ্রিয়তা এবং তাৎক্ষণিকভাবে আর্থিক লাভের পেছনে যে বা যারা ছুটবে, তারা শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় টিকবে না। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমে যারা পাঠকের মধ্যে স্থায়ীভাবে আস্থার জায়গাটি তৈরি করতে পারবে, তারাই শেষ পর্যন্ত সফল হবে।

তাই, অনলাইন পত্রিকাগুলোকে নিজের স্বার্থেই আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা মনে রেখে সাংবাদিকতার শক্তিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। এতে দেশ ও দশের যেমন উপকার হবে, তেমনি অনলাইন পত্রিকার ব্যাপারে পাঠকের আস্থার সঙ্কটও কেটে যাবে।

বস্তুনিষ্ঠ ও ইতিবাচক সাংবাদিকতাই বৃহদার্থে জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে। যেসব সংবাদমাধ্যম এই আদর্শকে ধারণ করবে, পাঠকের কাছে শেষ পর্যন্ত তারাই টিকে থাকবে আর বাকিগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে।

সজীব সরকার : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠাতা : মিডিয়াস্কুল ডট এক্সওয়াইজেড।