টেক্সাসের বন্যার ভয়াবহতা ও বিপর্যয়ের পেছনে প্রধান তিন কারণ
ফিচার ও মতামত ডেস্ক
প্রকাশিত: ২২:৪০, ৯ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০১:১৫, ১০ জুলাই ২০২৫

গত বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত টেক্সাসের কিছু অংশে প্রায় ১২ ইঞ্চির মতো বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
টেক্সাসে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় এরইমধ্যে অঙ্গরাজ্যটির বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। শিশুদের গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পসহ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রগুলো বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
আগাম সতর্কবার্তা না থাকায় গত শুক্রবার ভোরে হঠাৎ করে শুরু হওয়া প্রবল এ বন্যার পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঘুমন্ত শিশুসহ ক্যাম্পের অন্যান্য কর্মীদের। পুরো এক মাসের সমপরিমাণ বর্ষণ এক রাতের মধ্যে সংঘটিত হওয়ায় গোয়াদালুপ নদীর প্লাবিত হয়ে আকস্মিক ভয়াবহ এ বন্যার সৃষ্টি হয়।
অকল্পনীয় এ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এরইমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১০০’রও বেশি মানুষের। নিখোঁজ রয়েছে ১৭১ জন। এর মধ্যে ওই ক্যাম্পে মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে ২৭। প্রচণ্ড পানির স্রোতে ভেসে গেছে ওই ক্যাম্পের সবুজ ছাদওয়ালা কেবিনগুলো। সঙ্গে করে নিয়ে গেছে মাত্র ৮ বছর বয়সী নিষ্পাপ প্রাণ। আর পেছনে রেখে গেছে প্রলয়ংঙ্কারী বিপর্যয়ের ক্ষতচিহ্ন।
ক্যামেরায় ধারণকৃত বিভিন্ন ফুটেজে দেখা গেছে কিভাবে মাত্র ২৭ মিনিটের মধ্যে পানি বেড়ে গিয়ে একটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে বিরাবহীনভাবে চলছে অনুসন্ধান তৎপরতা। একইসঙ্গে, এ প্রশ্নও সামনে এসে যাচ্ছে যে এতো মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে কি আরও কিছু করা যেতো না!
এ ক্ষেত্রে মর্মান্তিক এ ঘটনার পেছনে প্রধান তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা, অবকাশযাপনের প্রধান এলাকা এবং সময় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের কারণে বর্তমানে ওই এলাকার বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণ আর্দ্রতা বিরাজ করছে। যার প্রভাবে মেক্সিকোতে এরইমধ্যে ব্যাপক আকারে বন্যা হয়েছে। পরবর্তীতে এটিই উত্তরের দিকে ধাবিত হয়ে এ অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
টেক্সাসের কের কাউন্টির যে এলাকায় ক্যাম্পটি ছিলো, সেটি মূলত পাহাড়ি এলাকা। ফলে, ওই এলাকায় আর্দ্রতাপূর্ণ বাতাস সহজেই উপরের উঠে গিয়ে সেখানে বিশাল আকারের ঝড়ো মেঘ তৈরি করেছে। এই ঝড়ো মেঘের আয়তন এতোই বেশি ছিলো যে সেটি নিজেই নিজের একটি আবহাওয়া ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলে এবং বিশাল এলাকাজুড়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়।
কিন্তু, বিশাল এ মেঘপুঞ্জ খুব ধীরে ওই এলাকার উপর দিয়ে যাচ্ছে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। এর ফলে বজ্রসহ ব্যাপক ঝড়ো বৃষ্টি হয়েছে এবং গোয়াদালুপ নদীসহ এর তীরবর্তী বিশাল এলাকায় বন্যার পানির পরিমাণ অবশ্বিাস্য দ্রুত গতিতে বেড়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, শুধু দক্ষিণ-মধ্য কের কাউন্টিজুড়েই মাত্র তিন থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ৫ থেকে ১০ ইঞ্চি (১২৫ থেকে ২৫০ মিলিমিটার) বৃষ্টিপাত হয়েছে। এমনকি গত বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত টেক্সাসের কিছু অংশে প্রায় ১২ ইঞ্চির মতো বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
গত ২৫ বছর ধরে কেরভিল এলাকায় জুলাইয়ে গড়ে ২ ইঞ্চির মতো বৃষ্টিপাত হয়ে আসছে। অর্থাৎ, এই হিসেবে এই এলাকায় মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় চার মাসের সমপরিমাণ বৃষ্টিপাত একসঙ্গে হয়েছে।
এছাড়া, যে সময়ে এই বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, সেই সময়টিও এতো প্রাণহানির আরেকটি কারণ। কেননা, বৃহস্পতিবার রাতে ওই এলাকায় নদীর পানি প্লাবিত হয়ে যখন আকস্মিক বন্যা শুরু হয় তখন টেক্সাসের অধিকাংশ বাসিন্দাই ঘুমিয়ে ছিলো।
বিপর্যয়কর এ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের কাছে আগাম কোনো সতর্কবার্তা ছিলো না। ফলে, অধিকাংশ বাসিন্দারই ঘুম ভাঙ্গে ভয়ানক এক পরিস্থিতির মধ্যে। বৃহস্পতিবার বিকেলে সম্ভাব্য বন্যা সম্পর্কিত একটি বার্তা জারি করা হয়।
কিন্তু,বন্যা সম্পর্কে নিশ্চিত সতর্কবার্তাটি আসে মধ্যরাতের পর। এ সময় এলাকার বাসিন্দাদের উঁচু জায়গায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর পরবর্তী দুই ঘণ্টার মধ্যে আবার আকস্মিক বন্যার সতর্কবার্তা দেওয়া হয় এবং রাতব্যাপী মানুষজনের ফোনে সতর্কবার্তা সম্বলিত বার্তা আসতে থাকে।
কেরভিলের নগর ব্যবস্থাপক ডাল্টন রাইস যখন ভোর সাড়ে তিনটা সময় নদীর পাড়ে জগিং করতে বের হন তখন খুব হালকা বৃষ্টিপাত হচ্ছিলো বলে জানান। কিন্তু, এর মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে কের কাউন্টির জন্য আকস্মিক বন্যার সতর্কবার্তা জারি করা হয়।
দেশটির জাতীয় আবহাওয়া অধিদফতরের জারি করা সতর্কবার্তায় এ পরিস্থিতিকে ‘তুলনামূলক বিপদজনক’ বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, এর আগেই ওই এলাকায় ব্যাপক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো।
দুর্ভাগ্যবশত ক্যাম্প মিসটিকও ছিলো ওই স্থানেই যেখানে টানা কয়েকঘণ্টা ধরে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। যদিও কের কাউন্টির নয়নাভিরাম পাহাড়ি এলাকা, অসংখ্য নদী ও হ্রদের কারণে পর্যটকদের জন্য বরাবরই এটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান।
কিন্তু, এর একটি অসুবিধাও রয়েছে, যার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা বছরের পর বছর ধরে এর শিকার হয়ে আসছে। কারণ, আকস্মিক বন্যার কারণে এ অঞ্চলের নামই হয়ে গেছে ‘আকস্মিক বন্যা দুর্গত গলি।’
আর, এ কারণেই গত শুক্রবার ভোরে ভারী বৃষ্টিপাতের পানি সরাসরি পাহাড় থেকে নেমে আশেপাশের নদীগুলোর মধ্যে পরে এবং খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো প্লাবিত হয়।
এভাবে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা নদী তীরবর্তী নিম্নাাঞ্চলগুলো খুব কম সময়ের মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এভাবেই নদী তীর থেকে ৫০০ ফিটেরও কম উঁচুতে থাকা ওই ক্যাম্প বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় এবং বেশকিছু শিশু বন্যার স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়ে মারা যায়। আর, কিছু শিশু এখনও নিখোঁজ রয়ে গেছে।
এদের মধ্যে যাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তাদের ভাষ্যমতে, গাছ উপড়ে পড়ে, কায়াক নৌকা গাছের মাথায় উঠে গিয়ে ক্যাম্পের অবস্থা এতোটাই বিপর্যস্ত হয়েছে যে, তা আর এখন চেনার উপায় নেই। এমনকি ক্যাম্পে অবস্থান করা অনেককে পানি থেকে টেনে তুলতেও হয়েছে।
এদিকে, এ ধরনের একটিমাত্র ঘটনা হয়তো ক্রমাগত উষ্ণ হয়ে চলা পৃথিবী এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে এ উষ্ণতার প্রভাব ধরে হলেও আমাদের পৃথিবীর জলবায়ু উপর পড়ছে, যার প্রভাব আমরা দিন দিনই প্রত্যক্ষ করছি।
কেননা, জলবায়ুর মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণতার কারণে মেক্সিকো উপসাগরের সমুদ্র উপরিতল স্বাভাবিকের তুলনায় উষ্ণ হয়ে চলেছে। আর, উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে সাগরের পানি বাষ্পীভবনের মধ্য দিয়ে আকাশে প্রচুর আর্দ্রতাপূর্ণ মেঘের সৃষ্টি করছে, যা শেষ পর্যন্ত প্রবল ঝড় বা ঘূর্ণিঝড়ে রুপ নিয়ে লোকালয়ে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে চলেছে।
সূত্র : বিবিসি।