ফিচার ও মতামত

সবার আগে সব খবর : বেশি খবর, ভুল খবর এবং নারকোটাইজিং ডিসফাংশন

সজীব সরকার

প্রকাশিত: ০০:৩৬, ২১ আগস্ট ২০২২

সবার আগে সব খবর : বেশি খবর, ভুল খবর এবং নারকোটাইজিং ডিসফাংশন

অকারণ বাড়তি খবরের প্রবাহ দরকারি খবর থেকে পাঠকের মনোযোগ নষ্ট করে। প্রতীকী ছবি।

এখনকার সময়ে গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে। প্রতিযোগিতা থাকা খারাপ কোনো বিষয় নয়, তবে এই প্রতিযোগিতার কারণ ও ধরন বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

গণমাধ্যমে প্রতিদিনের সাধারণ কিছু খবর থাকে। যেমন : সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত, সভা-সেমিনার, রাজনৈতিক কোনো দলের সাংবাদিক সম্মেলন, মানববন্ধন-প্রতিবাদ-সমাবেশ, শেয়ার বাজার কিংবা কোনো দুর্ঘটনার খবর সব গণমাধ্যমই কম-বেশি প্রকাশ করে। এসব খবর জানতে গণমাধ্যমগুলোকে বেগ পেতে হয় না; এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বেশিরভাগ সময় এমন তথ্য নিজ গরজেই গণমাধ্যমগুলোকে জানায়। ফলে এসব সাধারণ খবর নিয়ে গণমাধ্যমগুলোর কৃতিত্বের কিছু নেই। আর এখানেই আসে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতার বিষয়টি।

প্রতিদিনের সাধারণ খবর সব গণমাধ্যমের কাছেই থাকে। তাই এসব তথ্য পাঠককে কেবল জানানো নয় বরং কে আগে জানাতে পারে - এটিই হয়ে গেছে বড় কথা। কাগজে ছাপা পত্রিকাগুলো এমনিই একদিন পিছিয়ে থাকে তার চরিত্রগত কারণেই; একদিনের ঘটনা পরেরদিনের কাগজে ছাপা হয়। কিন্তু রেডিও ও টেলিভিশনের কারণে পাঠক দিনের ঘটনা দিনেই জেনে যাচ্ছে; এই অবস্থায় পত্রিকাগুলো ওই খবর প্রকাশের পাশাপাশি ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাপার ব্যাপারটিকেও গুরুত্ব দেয়। কিন্তু অনলাইননির্ভর পত্রিকা বাজারে আসার পর এই পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।

রেডিও কিংবা টেলিভিশন আগে কাগজে ছাপা পত্রিকা থেকে এগিয়ে থাকলেও অনলাইন পত্রিকা এই দুটি মাধ্যমকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। রেডিও-টেলিভিশনে খবর বা বুলেটিন প্রচারের নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ থাকে। ফলে, খুব বেশি বড় ঘটনা (ব্রেকিং নিউজ) না ঘটলে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে তাদের খবর জানানোর কোনো সুযোগ তেমন নেই। টেলিভিশনগুলো অবশ্য স্ক্রলে দু-চার শব্দে শিরোনামের মতো করে খুব সংক্ষেপে নতুন তথ্যগুলো দিতে পারে; তবে তা অবশ্যই পাঠকের জন্যে সবসময় যথেষ্ট নয়। কিন্তু অনলাইন পত্রিকাগুলো যখন যে খবর পাচ্ছে, প্রয়োজনে দু-চার লাইনে হলেও তাৎক্ষণিকভাবেই তা প্রকাশ করতে পারে এবং পরক্ষণেই বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে। আর এ চ্যালেঞ্জের সামনে টিকে থাকতে কাগুজে পত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও নিজেদের মূল মাধ্যমের পাশাপাশি অনলাইন ভার্সন চালু করেছে।

এর বাইরে রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ারও প্রভাব। পাঠকেরা যেহেতু এখন অনেক বেশি মাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল, গণমাধ্যমগুলো তাই নিজেদের মূল মাধ্যমে খবর প্রচারের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াতেও ওইসব খবর শেয়ার করতে তৎপর থাকে। এখানেই শেষ নয়; পাঠকের কাছে সবার আগে খবর পৌঁছে দেওয়ার কৌশল হিসেবে এসব গণমাধ্যম পাঠকের মোবাইল ফোনে 'এসএমএস অ্যালার্ট' হিসেবেও তথ্য জানিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু, এই যে 'সবার আগে সব খবর' প্রচারের এই তীব্র প্রতিযোগিতা, গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় এর আড়ালে পড়ে যাচ্ছে : এক. 'সবার আগে খবর' হলেই হবে না- হতে হবে সঠিক খবর, নির্ভুল খবর। দুই. প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে শুধু আগে-ভাগে খবর দেওয়াই নয়, গণমাধ্যমগুলো খবরের সংখ্যাও বাড়াচ্ছে; আর এতে অনিবার্যভাবেই খবরের মান সন্তোষজনক হচ্ছে না। বিশেষ করে অনলাইন পত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রে এই সঙ্কট সবচেয়ে বেশি। কেবল অনলাইননির্ভর পত্রিকাই হোক অথবা অন্য গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সন- প্রতিদিন কে কতো বেশি খবর পোস্ট করতে পারে, সেটিই এখন সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে - খবরের ভিত্তি, মান বা গ্রহণযোগ্যতা নয়।

এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রভাব কেবল পাঠককে আগে খবর দিতে গিয়ে ভুল খবর দেওয়া কিংবা অকারণ অতিরিক্ত সংখ্যক (এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সস্তা, দুর্বল) খবর দেওয়ার মধ্যেই সীমিত থাকে না; এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাবও রয়েছে। এই প্রভাবটিকে অ্যাকাডেমিক পরিভাষায় নারকোটাইজিং ডিসফাংশন (Narcotizing Dysfunction) বলা হয়।

মনে রাখতে হবে, গণমাধ্যমের মূল কাজ হলো পাঠককে দরকারি ও সঠিক তথ্য সরবরাহ করা- অকারণ বাড়তি তথ্য সরবরাহ করা নয়। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একটি বিষয়ে গণমাধ্যমগুলো পাঠকের প্রয়োজন বা আগ্রহ এমনকি ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি তথ্য দিতে থাকে। প্রথমদিকে খুব উৎসাহী থাকলেও অতিরিক্ত তথ্যের চাপে পাঠকরা ক্রমেই ওই বিষয়ে আগ্রহ হারাতে শুরু করে। কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত তথ্য প্রবাহের কারণে ওই বিষয়ে উৎসাহী বা উদ্যোগী না হয়ে এর বিপরীতে বরং আগ্রহ হারিয়ে ফেলার ঘটনাই নারকোটাইজিং ডিসফাংশন।

উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে বোঝার চেষ্টা করা যাক : বন্যা বা এ ধরনের দুর্যোগের সময় গণমাধ্যমগুলো খবর প্রচারের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে নির্বিচারে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এর ফলে প্রত্যেকটি গণমাধ্যম অন্যের চেয়ে বেশি খবর দেওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে সারা দিন এবং কয়েকদিন ধরে কেবল বন্যার খবর পেতে পেতে মানুষ এ বিষয়ে সংবেদনশীলতা ও আগ্রহ হারায়। এমনকি, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উদ্যোগের বদলে মানুষের দুর্ভোগ এবং দায়িত্বশীলদের দুর্নীতির খবর নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাতেই পাঠকদের কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে। আর এ বিষয়ে একের পর এক খবর (এমনকি পুরনো খবরই বারবার) পেতে পেতে এক সময় ওই বিষয়ে পাঠকেরা আগ্রহ হারায় এবং এ নিয়ে তারা আর মনোযোগী হয় না। করোনা মহামারী শুরুর পর সংশ্লিষ্ট নানা ঘটনার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে।

মাদকের ক্রমাগত ব্যবহার যেমন ব্যক্তির চেতনাবোধ বা মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা কমিয়ে দিতে শুরু করে, গণমাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তথ্যের এমন অহেতুক বাড়তি সরবরাহও তেমনি অডিয়েন্সের (পাঠক-দর্শক-শ্রোতা) সংবেদনশীলতা অর্থাৎ আগ্রহ কমিয়ে দেয়। ব্যবহারকারীর ওপর মাদকের এমন প্রভাবের সঙ্গে মিল রয়েছে বলে এর সঙ্গে তুলনা করে অডিয়েন্সের ওপর গণমাধ্যমের এমন প্রভাবের এ নামকরণ হয়েছে।

এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো, গণমাধ্যমের এই ভূমিকাকে 'ফাংশন' (কর্ম বা উদ্যোগ) না বলে বরং 'ডিসফাংশন' (কর্মহীনতা বা উদ্যোগহীনতা কিংবা কর্ম বা উদ্যোগের অনুপস্থিতি) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (narcotize rather than to energize)। এর কারণ হলো, তথ্য এখানে মানুষকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে উদ্যমী বা উদ্যোগী না করে বরং এর উল্টোটি করছে অর্থাৎ নির্বিচারে তথ্য দিতে দিতে কোনো বিষয়ে মানুষের জানার বা কোনো সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার আগ্রহকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, মাদক বা এ ধরনের ওষুধ মানুষের শরীর-মনকে যেভাবে স্তিমিত বা অবসাদগ্রস্ত করে দেয়, কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত তথ্যও একইভাবে মানুষকে ওই নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি অসংবেদনশীল করে তোলে। এজন্যেই এই প্রক্রিয়াটিকে নারকোটাইজিং ডিসফাংশন বলা হয়েছে।

গণমাধ্যমের এই নেতিবাচক ভূমিকাকে তাত্ত্বিক পল এফ লাজারফেল্ড (Paul F. Lazarsfeld) এবং রবার্ট কে মার্টন (Robert K. Merton) ১৯৪৮ সালে তাদের লেখা 'ম্যাস কমিউনিকেশন, পপুলার টেস্ট অ্যান্ড অর্গানাইজড সোশ্যাল অ্যাকশন' (Mass Communication, Popular Taste and Organized Social Action) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রথম নারকোটাইজিং ডিসফাংশন হিসেবে উল্লেখ করেন।

দিন যতো যাচ্ছে, গণমাধ্যমের 'বাজার' ততো কঠিন হচ্ছে- এ কথা ঠিক। তবে এভাবে মানহীন বা সস্তা খবর কিংবা অযথা অনেক খবরের যোগান দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যাবে না। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে একদিকে যেমন খবরের মান দুর্বল হচ্ছে, অন্যদিকে আবার মাত্রাতিরিক্ত খবরের এই দৌরাত্ম্যে পাঠক ভালো খবর বা দরকারি ঘটনা থেকে মনোযোগ বা আগ্রহ হারাচ্ছে। এভাবে সাংবাদিকতার মান এবং বিশ্বাসযোগ্যতা - দুটোই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

তাই, এমন প্রতিযোগিতার প্রবণতার বিপরীতে বরং দরকারি ও সঠিক খবর দেওয়ার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আর প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে বা এগিয়ে যেতে হলে কেবল সবার আগে বা বেশি বেশি খবর দেওয়ার প্রবণতাও ত্যাগ করতে হবে। এজন্যে প্রতিদিনের সাধারণ খবরের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে গণমাধ্যমগুলোকে নিজেদের 'এক্সক্লুসিভ' আধেয় তৈরি করতে হবে। নিজেদের অনুসন্ধানী খবর, বিশেষ খবর, খবরের বিশ্লেষণ, বিশেষজ্ঞের মন্তব্য-মতামত-ব্যাখ্যা, ফিচার, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি আধেয় দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, আগে বা বেশি খবর দিলেই কেবল হবে না- এসব খবর সঠিক এবং পাঠকের জন্যে দরকারি হওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। না হলে আগামীর কঠিন দিনগুলোতে নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বস্ত খবরের উৎস হিসেবে গণমাধ্যমগুলো নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হবে।

সজীব সরকার : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠাতা : মিডিয়াস্কুল ডট এক্সওয়াইজেড।