শিল্প-সাহিত্য-বিনোদন

চলে গেলেন সবার প্রিয় বন্ধু ‘চ্যান্ডলর বিং’!

শিল্প-সাহিত্য-বিনোদন ডেস্ক

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ২৯ অক্টোবর ২০২৩;  আপডেট: ২২:৪৮, ৭ নভেম্বর ২০২৩

চলে গেলেন সবার প্রিয় বন্ধু ‘চ্যান্ডলর বিং’!

নিজের জীবনের নানা উত্থান-পতন নিয়ে গত বছর স্মৃতিচারণমূলক বই প্রকাশ করেন ম্যাথিউ।

মার্কিন অভিনেতা ম্যাথিউ পেরি আর নেই। ৯০ এর দশকে প্রচারিত বিশ্বখ্যাত মার্কিন কমিডি ধারাবাহিক ‘ফ্রেন্ডস’ এ অভিনয় করে খ্যাতির চূড়ায় উঠা এ অভিনেতা ভক্তদের কাছে ‘চ্যান্ডলর বিং’ নামেই বহুল পরিচিত। পৃথিবীর সব ভক্ত-অনুরাগীদের শোকে স্তব্দ করে দিয়ে মাত্র ৫৪ বছর বয়সেই চলে গেলেন জনপ্রিয় এ অভিনেতা। গতকাল শনিবার তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।

পেরির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে এখনও কিছু জানা না গেলেও, এর সঙ্গে মাদক বা নেশা জাতীয় বস্তুর সম্পর্ক ছিলো না বলে জানা গিয়েছে। বর্তসানে লস অ্যাঞ্জেলসের পুলিশ অভিনেতার মৃত্যুর সঠিক কারণ সম্পর্কে তদন্ত করছে বলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে। তদন্ত শেষে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে বলে জানা গিয়েছে।

লস অ্যাঞ্জেলসের স্থানীয় গণমাধ্যম এলএ টাইমস ও সেলিব্রেটি নিউজ সাইট টিএমজেড প্রথম পেরির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে। এর আগে শনিবার স্থানীয় সময় বিকাল প্রায় চারটায় জরুরি খবর পেয়ে প্যাসিফিক প্যালিসেডস নামের ঠিকানায় পৌঁছে অগ্নি নির্বাপক দল।

এ সময় জরুরি ভিত্তিতে পানি থেকে কাউকে উদ্ধার করা প্রয়োজন বলে জানানো হলেও তখন পেরির নাম প্রকাশ করা হয়নি । পরে পেরির বাসার গরম পানির বাথটাব থেকে ডুবন্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয় । এ সময় তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও তা আর সম্ভব হয়নি বলে ওই বিভাগের মুখপাত্র ব্রায়ান হ্যামফ্রে জানান।

ম্যাথিউ পেরির অকাল প্রয়াণে শোক জানিয়েছে ‘ফ্রেন্ডস’ ধারাবাহিকটির প্রযোজনার দায়িত্বে থাকা ওয়ার্নার ব্রোস টিভি। এ বিষয়ে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বলা হয়, ‘আমাদের প্রিয় বন্ধু ম্যাথিউ পেরির মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। ম্যাথিউ ছিলো একজন অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান অভিনেতা এবং ওয়ার্নার ব্রোস টেলিভিশন পরিবারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।’

শোক জানিয়েছেন ফ্রেন্ডসে চ্যান্ডলরের প্রথম জীবনের প্রেমিকা ‘জেনিস’ হিসেবে অভিনয় করা অভিনেত্রী ম্যাগি উইলারসহ আরও অনেকেই। শোক ও ভালোবাসা জানিয়ে চলেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা তার অগুণিত ভক্ত-দর্শক। তবে তার পরিবার বা ফ্রেন্ডস ধারাবাহিকে তার প্রধান সহশিল্পীদের কাছ থেকে এখনও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায় নি।

১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে অভিনেতা বাবা জন বেনেট পেরি ও সাংবাদিক মা সুজান পেরির ঘরে জন্ম নেন ম্যাথিউ। পরে তার শিশু বয়সে মা-বাবার ছড়াছাড়ির পর মায়ের সঙ্গে কানাডায় পাড়ি জমান তিনি। কানাডার ওটোয়ায় পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা তার। পরে কিশোর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে বাবার কাছে ফিরে আসার পর থেকেই অভিনয়ে নিজের পরিচয় গড়ে তোলার কাজে মনোযোগ দেন ম্যাথিউ।

এ সময় ‘বয়েজ উইল বি বয়েজ’ এবং ‘গ্রোয়িং পেইন’সহ আরও বেশ কিছু ধারাবাহিকে কাজ করলেও ‘ফ্রেন্ডস’ এ চ্যান্ডলর বিং নামের চরিত্রই আন্তর্জাতিক মহলে তাকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়।

ফ্রেন্ডস ধারাবাহিকে সহশিল্পীদের সঙ্গে ম্যাথিউ পেরি

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে বসবাস করা ছয় বন্ধুর জীবনকাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছিলো কমেডি ধারাবাহিক ফ্রেন্ডস। ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রচারিত হওয়া এ টিভি ধারাবাহিকটি এখনও পর্যন্ত জনপ্রিয় কমেডি ধারাবাহিকের মধ্যে অন্যতম।

সে সময় এর শেষ পর্বটি দেখেছিলো প্রায় ৫২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন দর্শক। যার মধ্য দিয়ে এটি ২০০০ সালের সবচেয়ে বেশি দেখা টিভি ধারাবাহিকে পরিণত হয়।

তিন মেয়ে ও তিন ছেলে বন্ধুর প্রতিদিনকার জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, চাকরি, বন্ধুত্ব, পরিবারসহ জীবনের আনন্দ-হতাশা-ব্যর্থতার কাহিনী সর্বোপরি ছয়জনের নির্মল বন্ধুত্ব নিয়ে গড়ে ওঠা এ ধারাবাহিকটি বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের লাখো দর্শকের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

এতে চ্যান্ডলর বিংয়ের চরিত্র রূপায়ন করা ম্যাথিউ পেরির সহজ-স্বাভাবিক-বাস্তবসম্মত অভিনয় এবং এ চরিত্রের হাস্যরসাত্মক-বিদ্রুপাত্মক সংলাপ এখনও সবার মুখে মুখে ফিরে। ২০০২ সালে ফ্রেন্ডসের এ চরিত্রের জন্য সম্মানজনক অ্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন ম্যাথিউ পেরি।

চ্যান্ডলর বিংসহ এ ধারাবাহিকের অন্যান্য প্রধান চরিত্র র‌্যাচেল (জেনিফার অ্যানিস্টন), মনিকা (কর্টনি কক্স), রজ (ডেভিড শুমার), জোয়ি (ম্যাট লি ব্লাঙ্ক) এবং ফিবিও (লিসা কুডরো) সারা বিশ্বের ‘ফ্রেন্ডস’প্রেমীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়।

সেই নব্বইয়ের দশকের ধারাবাহিকটি নিয়ে এখনও দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ ও ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। এমনকি ২০০৪ সালে শেষ হওয়ার ১৭ বছর পর ২০২১ সালে ফ্রেডস ধারাবাহিকের যে ‌'রিইউনিয়ন' প্রচারিত হয়, সেটা নিয়েও ছিলো ভক্ত-দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ, আগ্রহ ও উন্মাদনা। 

তবে কখনো বিয়ে না করা ও কোনো সন্তান না থাকা ম্যাথিউ পেরির জীবনের ওই সময়টায় মারাত্মক মাদকাসক্তির সঙ্গেও লড়তে হয়েছে তাকে। এজন্য বহুবার পেরিকে যেতে হয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে । এমনকি মাদক সেবন তার অন্ত্রকে এমন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলো যে ১৪টি সার্জারিও করাতে হয়েছে তার। আর পুরোপুরি সেরে উঠতে মাসের পর মাস কাটাতে হয়েছে হাসপাতালের বিছানায়।

 ২০০৪ সালে ৩০তম পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করছেন ম্যাথিউ পেরি।

২০২২ সালে প্রকাশিত তার লেখা স্মৃতিচারণমূলক বই - ‘ফ্রেন্ডস, লাভারস, অ্যান্ড দ্য বিগ টেরিবল থিংক: এ মেমোয়ার’ এ এসব তথ্য তুলে ধরেন তিনি।

এমনকি মাদকাসক্ত থাকার কারণে ফ্রেন্ডসে শুটিংয়ের তিন বছর সময় তার স্মৃতি থেকে মুছে গেছে বলেও বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন পেরি।

গত বছর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পেরি বলেন, ‘আমি ধারাবাহিকটি দেখিনি, আমি এটা দেখি না। কারণ এটা দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় আমার ভয়াবহ আসক্তির কথা। একেকটা পর্বে নিজেকে দেখলেই আমি বলতে পারবো কখন কি হয়েছিলো। এজন্য আমি এটা দেখিনা, কারণ এটা দেখলে আমি শুধু ওইসবই দেখি।’

তবে তিনি এটাও বলেছিলেন যে খুব শিগগিরই তিনি ধারাবাহিকটি দেখা শুরু করবেন। কারণ তার মতে, ‘এটা এমন অসাধারণ একটা বিষয় যা বহুদিন ধরে একের পর এক জেনারেশনের মনে অদ্ভূতভাবে জায়গা করে নিচ্ছে।’  

ফ্রেন্ডস ছাড়াও `ফুলস রাশ ইন', `অলমোস্ট হিরোস' এবং `হোল নাইন ইয়াডর্স' এর মতো হলিউডের জনপ্রিয় সিনেমাগুলোতে অভিনয় করেছেন এ গুণী অভিনেতা।

এছাড়া `ফ্রেন্ডস' ধারাবাহিকটি শেষ হওয়ার পর আরও কিছু টিভি ধারাবাহিককে অভিনয় করে সফলতা পেলেও ভক্তদের হৃদয়ে চ্যান্ডলর বিং হিসেবে তিনি যে জায়গা করে নিয়েছেন, তা  চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

তবে মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যাথিউ পেরি বলেছিলেন, ‌‌‌'আমার মৃত্যুর পর মানুষ আমাকে ফ্রেন্ডস তারকা হিসেবে নয় বরং মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করা এক সংগ্রামী মানুষ হিসেবে মনে রাখবে, এটাই আমার চাওয়া।'

তবে এটাও সত্যি যে, ফ্রেন্ডস ধারাবাহিকের চ্যান্ডলর বিং চরিত্র বিশ্বব্যাপী এতো সফল হয়েছিলো ম্যাথিউ পেরির অসাধারণ অভিনয় গুণের কল্যাণেই। তাই চ্যান্ডলর কে মনে রাখা মানে তো ম্যাথিউ পেরিকেই স্মরণ করা। তাই চ্যান্ডলরই হোন বা ম্যাথিউ পেরি, ভক্ত-দর্শকদের মনে তিনি অম্লান হয়ে থাকবেন আজীবন, ঠিক একইভাবে।

ভালো থাকবেন ‘মিস্টার চ্যান্ডলর বিং’ ম্যাথিউ পেরি।

সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, ডয়চে ভেলে।